সহেলী সাহা , কলকাতা: শরতের আকাশ আর মাটির গন্ধ। কুমোর পাড়ায় চলছে মৃৎ শিল্পীদের শিল্পকর্মে সজ্জিত মূর্তি গড়ার কাজ, অন্যদিকে, হস্তশিল্পের ঐতিহ্য, আধুনিকতার মেলবন্ধন। গত ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার গ্যালারি গোল্ডে আয়োজিত হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী, ‘আর্ট অ্যান্ড অটাম’। আয়োজক সংস্থা ‘খামখেয়াল’ এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে যে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা একসঙ্গে হাতে হাত রেখে চলতে পারে, যার ছোঁয়ায় শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
খামখেয়ালের শিল্পকর্ম ও হস্তশিল্প প্রদর্শনী
যে গ্যালারির দেওয়ালে বছরের বেশিরভাগ সময় চিত্রশিল্পীদের আঁকা সারি সারি ছবি ঝুলতে দেখা যায়, সেখানেই এবার একটু অন্য রকম গল্প তৈরি হল। মাটির পুতুল, তালপাতার সেপাই, হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু সভ্যতার বাঁশি পুতুল আর বাংলার নিজস্ব হস্তশিল্পের নানা রূপ নিয়ে যেতে উঠেছিল। কিন্তু এগুলি শুধুই প্রদর্শনী নয়, প্রতিটি শিল্পকর্ম যেন এক একটি গল্প বলছে। এক সময়ের অবহেলিত এই শিল্পগুলি আজ আধুনিকতার মোড়কে সেজে উঠে নতুন প্রাণ পেয়েছে। এই প্রদর্শনী যেন এক প্রতিবাদের ভাষা, যা প্রমাণ করে দেয় যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক।
মাটির পুতুল কিংবা তালপাতার সেপাই শুধু খেলনা নয়, বরং এগুলি বাংলার শিল্পকলার এক অনবদ্য অংশ। এই প্রদর্শনীতে এমন অনেক শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে, যা বাংলার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের হাতে তৈরি। এই শিল্পীরা তাদের জীবন ও জীবিকার সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাদের হাতে তৈরি প্রতিটি শিল্প কর্মে মিশে আছে তাদের স্বপ্ন, শ্রম আর আবেগ। এই প্রদর্শনী শুধু শিল্পের উদযাপন নয়, বরং সেই সকল শিল্পীদের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা, যারা নীরবে শিল্পের পরিচর্যা করে চলেছেন। তাদের শিল্পকে আধুনিক বাজারে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ‘খামখেয়াল’-এর এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
‘খামখেয়াল’-এর আয়োজক জানান, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে সমসাময়িক সমাজে প্রতিষ্ঠা করা এবং এই শিল্পীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। এটি কেবল একটি প্রদর্শনী নয়, বরং সামাজিক উন্নয়নের এক পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া শিল্পগুলি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।
আরও পড়ুন, বিয়ে ও পুজোর মরশুমে সুন্দর ত্বক পেতে চান তাহলে এই ছোট্ট নিয়মগুলি মেনে চলুন।
প্রদর্শনী ঘুরে দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। প্রতিটি শিল্পকর্মের মধ্যে যেন এক কাব্যিক সত্তা লুকিয়ে রয়েছে। মজিলপুরের মাটির পুতুলের চোখে যেন হাজারো গল্প আর সুনীল দাসের তালপাতার সেপাইয়ের হাতে যেন বাংলার ইতিহাস, অন্যদিকে রাজকুমার দেবনাথের সিন্ধু সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া টেরাকোটার বাঁশি পুতুল। এই শিল্পকর্মগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়ের কথা, আমাদের ঐতিহ্যের কথা। একইসাথে, এরা আমাদের শেখায় কিভাবে সময়ের সাথে পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করতে হয়।
এই প্রদর্শনী তাই কেবল একটি শিল্প প্রদর্শনী নয়, এটি আবেগ, ভালোবাসা, আর সংগ্রামের এক অসাধারণ মিশ্রণ। ‘আর্ট অ্যান্ড অটাম’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের ঐতিহ্যের গভীরতা অনেক, আর তা আধুনিকতার স্পর্শে আরও উজ্জ্বল হতে পারে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ‘খামখেয়াল’ যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল, যেখানে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।